তুমি একদিন সত্যি সেরে উঠবে

[ad_1]

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com


প্রিয় ফরিদপুর। এই সময়ে বড্ড বেশি মনে পড়ছে তোমায়। ভালো লাগা আর ভালোবাসার অনেক স্মৃতিতে তুমি ভাস্বর। করোনাকালে বাড়ি ও তোমার মাঝে একটা সমানুপাতিক নাড়ির টান অনুভব করছি। বাড়িতে যত বেশি দিন থাকা হচ্ছে, তুমি ও তোমার স্মৃতির প্রতি আমি ততই দুর্বল হয়ে পড়ছি। এই নিঃসঙ্গ জীবনে তোমার ভালোবাসা আমাকে কুরে-কুরে খাচ্ছে। আজ বড় জানতে ইচ্ছে করে, তুমি কেমন আছো?


সারা পৃথিবীর মতো তোমার শহরেও শুদ্ধতা আর সজীবতার জয়গান হচ্ছে। তোমাকে ঘিরে থাকুক মুক্ত বাতাসের অবগাহন। তোমার শহরে আজ মানুষের অযাচিত কোলাহল নেই। নেই গাড়ির হর্ন বা নিত্যদিনের দূষিত ধোঁয়া। প্রকৃতি যেন তোমাকে আবার নতুন করে সাজিয়ে দিচ্ছে। জানো, বাড়িতে আমার বইয়ের ওপর ধুলোর আস্তর পড়ে আছে। তোমার ক্যাম্পাসে পথেঘাটে লেপ্টে আছে কৃষ্ণচূড়ার লাল কার্পেট। ক্যাম্পাসের পদ্ম ফুল, পুকুর পাড়ের হিজলগাছ সবাই তোমাকে নবরূপে সাজিয়েছে। তোমার অলিতে-গলিতে শ্রাবণের স্নিগ্ধ বারিধারা। বিকেলের ব্যালকনিতে খেলা করে মেঘ ও গোধূলির রোদ্দুর। রাতে জোনাকির আলো-আঁধারির খেলা দেখে মনে হয়, কোনো এক ভুতুড়ে শহর। তোমার আকাশ মাঝেমধ্যে বেশ গুমোট হয়। চোখ রাঙায় কালবৈশাখী। শহর জুড়ে বাতাসে বইছে কদমফুলের ঘ্রাণ। পদ্মা পাড়ে ছলছল ছুটে চলে ঢেউ। খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে বলেই এসব আমি জানি, তা কিন্তু না। তোমার প্রতি হৃদয়ের টান থেকেই এসব আজ অনুভব করছি। কোন অদৃশ্য সুতোয় যেন আটকে আছে আমাদের বন্ধন।


প্রাণের শহর। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা। আনন্দ-বেদনায়, অভাবে-যাতনায় বেঁচে থাকার আশ্রয়। ২০১৪ সাল থেকে একটা যৌবন যেন এখানে কেটে গেল। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়ে কিছু বই আর এক গাঁট্টি কাঁথা-কাপড় নিয়ে সেই হোস্টেলে ওঠা, তারপর হয়ে গেছে অর্ধযুগ। তোমার আলো-আঁধারেই আমার জীবনের এতটা বছর কীভাবে কেটে গেল, বুঝতে পারলাম না। ইন্টারের দুটি ঘটনা এখন বেশ মনে পড়ছে। কলেজের প্রথম দিন বা নবীনবরণে বক্তৃতা দেওয়া আর আন্তঃকলেজ ডিবেটিংয়ে বিজয়ী হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার স্বপ্ন পূরণ হলো না। ভগ্নহৃদয় নিয়ে অনার্সে রাজেন্দ্র কলেজে রসায়নে ভর্তি হওয়া। তারপর অ্যাসিড-ক্ষার সম্পর্কে কেটে গেল চারটি বছর। পৃথিবীর এই ক্রান্তিকালে এসব কথা শুধু ভেতরটা নাড়া দিচ্ছে।


কেমন আছো প্রিয় ক্যাম্পাস? তোমার সবুজ চত্বর শিক্ষার্থীদের পদচারণে এখন আর মুখরিত হয় না। তুমি নিঃসঙ্গ রাতের গভীরে নিস্তব্ধ হয়ে থাকা হাজারো রাতের তারাকে সঙ্গী করে দিনাতিপাত করছ। তোমার বুকজুড়ে আসন করেছে রাতের জোনাকি আর বাদুড়-চামচিকারা। খেলার মাঠে সবুজ ঘাসগুলো বড় হতে হতে নেতিয়ে পড়েছে উবু হয়ে একটার ওপর আরেকটা। ঘাসফড়িংয়েরা তাতে লাফিয়ে লাফিয়ে পাল্লা দিচ্ছে একজনার সঙ্গে আরেকজন। দূর থেকে উড়ে আসা অচেনা পাখিরা তাদের ধরে ধরে মনের আনন্দে আহার করছে। ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া, বকুল আর মেহগনিগাছগুলো ভেসে বেড়ানো মেঘের সঙ্গে মিতালি করছে। তোমার প্রাঙ্গণে কবে ফিরব জানি। আমার এই দীর্ঘশ্বাসের কথা তুমি বুঝে নিও। তোমার মতো আমিও করোনাকালের কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছি।


প্রিয় লাইব্রেরি জানি তুমিও ভালো নেই। তোমার আলোকময় জীবন নিঃসঙ্গ তালাবন্দী হয়ে পড়ে আছে। সারাক্ষণ জ্ঞানপিপাসুদের পদচারণায় মুখরিত প্রাঙ্গণটি এখন প্রাণহীন জনমানবশূন্য। কত দিন তোমার টেবিলগুলোতে কেউ বসে না। আলমারির বইয়ের ওপর ধুলোর আস্তরণ পড়ে আছে। এভাবে মলাটবন্দী থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠেছে বইয়ের চরিত্রগুলো। কোনো পাঠক তার বইয়ের পাতায় চোখ বোলাবে না, আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়বে না কোনো গল্প, কবিতা কিংবা উপন্যাসের উপাখ্যান—এটা সত্যি নিদারুণ কষ্টের।


কেমন আছো নদী গবেষণার সবুজ মাঠ? সাদীপুরের পরিপাটি রাস্তাঘাট, পল্লিকবির বাড়ির চত্বর। রেলস্টেশন কিংবা পদ্মার সিঅ্যান্ডবি ঘাট। জানি ভালো নেই। কত দিন সন্ধ্যার পর রেলস্টেশনে বসে এক টাকার শিঙারা খাওয়া হয় না। ‘এগারজনে’র সামাজিক কর্মকাণ্ড আর ‘রাখালী’র সাহিত্য সভা। রিপন ভাইয়ের অফিসে বসে চা খাওয়া। শীতের রাতে শহরের অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে কম্বল বিতরণ। বড় রাস্তার মাঝ দিয়ে পঙ্খীরাজের মতো রিকশা নিয়ে চলা। টাকা বাঁচাতে বা আড্ডার অছিলায় এক রিকশায় চারজন ওঠা। বাইসাইকেলে করে শহরের বিভিন্ন মসজিদে জুমার নামাজ পড়া। ক্রিকেট বা ফুটবলে প্রিয় দল জেতার পর আনন্দ মিছিল নিয়ে বের হওয়া। কত সুখ-দুঃখের মিষ্টিমধুর জীবনগাথা তোমাকে ঘিরে।


আমার দেখা ছোট শহর একদিন সারি সারি অট্টালিকায় ছেয়ে যায়। ধুলো আর যানজট তার নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। চোখের সামনে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে চায়নিজ আর বাহারি খাবারের রেস্টুরেন্ট। সারদা সুন্দরী কলেজ এলাকায় গেলে মনে হতো এটা ‘কোচিং সেন্টারের শহর’। এখানে কেবল জীবনমানের প্রতিযোগিতা। মেসের আলোচনায় উঠে আসত শহরে কার চোখের সামনে কে কী হতে দেখেছে।


লকডাউনের দুই মাস পার হতে চলল। বাড়িতে বসে না থেকে সবজি চাষে মনে দিলাম। নিজের হাতে লাগানো গাছের ফুল-ফল দেখলে মনটা ভরে যায়। পরম তৃপ্তিতে চক্ষু শীতল হয়ে আসে। বারবার গল্প-কবিতা লেখার চেষ্টা করেও লিখতে পারিনি। করোনায় মানুষের করুণাহীন নির্মম ঘটনাগুলো হৃদয়কে ব্যথিত করছে। জানি না কবে নাগাদ এই লকডাউন শেষ হবে। কবে স্বাভাবিক হবে জীবনের গতিপথ। এখনো এক বুক স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি, আমরা একদিন করোনা বিজয়ী হব। স্বপ্ন একদিন সত্যি হবে। এই শহর হবে আমার নিজস্ব আকাশ, পদ্মা হবে ব্যক্তিগত নদী। সেদিন একান্ত এক মহাকাশ হবে আমার এই শহর।


হ্যাঁ, তুমি একদিন সত্যি সেরে উঠবে!



*শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, রসায়ন বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর। aliakbarbdinfo17@gmail.com



[ad_2]

Source link
IRFAN H

Hi, This is IrfanH I love to travel and passing by gossip with friends.

Post a Comment

Please do not enter any spam link in the comment box

Previous Post Next Post