অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০–২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন। আর নতুন অর্থবছরের জন্য ৮ দশমিক ২ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তা শুধু উচ্চাভিলাষী নয়, কল্পনাপ্রসূতও বটে।
প্রত্যাশা ছিল, সরকার প্রবৃদ্ধিনির্ভর গতানুগতিক উন্নয়ন কৌশল থেকে বেরিয়ে আসবে। কেননা তা যে টেকসই হয় না, করোনা সংকটে তা স্পষ্ট হয়েছে। বাজেটে ব্যয়ের মাত্রা বেশি হলে আয়ও বেশি করতে হবে। কিন্তু সেই আয় কোথা থেকে আসবে, আর এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রাক্কলন কতটা বাস্তবভিত্তিক, সেই প্রশ্নও আছে। আগামী অর্থবছরে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। আয় ও ব্যয়ের বিপরীতে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হা্জার কোটি টাকা, যা দেশি–বিদেশি উৎস থেকে সংগ্রহ করার কথা আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় অর্থমন্ত্রী বাজেটে যে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেন, তা বাস্তবায়নই কঠিন হয়ে পড়ে। এবার করোনাকালীন অস্বাভাবিক অবস্থায় কীভাবে আয়ের এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর অজানা। কী মাত্রায় বাড়বে, কত দিন স্থায়ী হবে, তা–ও অজানা।
অর্থমন্ত্রী ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা বলেছেন। এর আগে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার যে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, তারও প্রধান উৎস ব্যাংকঋণ। ফলে বেসরকারি ব্যাংক খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। উচিত ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ না বাড়িয়ে অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যয় যথাসম্ভব কমানো।
অন্যদিকে ব্যয় বরাদ্দ নিয়ে সরকারের নীতিকৌশলেও বড় অসংগতি আছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে। এই খাতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ মাত্র ৫ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে ২৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। আর করোনা সংকটের সময় জরুরি ব্যয় হিসেবে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া এই অর্থ ব্যয় করার বিপদ সম্বন্ধেও সজাগ থাকতে হবে।
তবে অর্থমন্ত্রীর এবারের বাজেটে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক আছে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিল্পের করপোরেট কর কমানো, ব্যক্তিশ্রেণির আয়করের সীমা বাড়ানো, জীবাণুনাশক যন্ত্রের কাঁচামালসহ বেশ কিছু আমদানি পণ্যের শুল্ক রেয়াত, কৃষিযন্ত্রের মূসক অব্যাহতি ইত্যাদি। কিন্তু সংবাদপত্রশিল্পের যে দাবিগুলো ছিল, তা উপেক্ষিত থেকে গেছে। নিউজপ্রিন্টের ওপর আমদানি শুল্ক বাতিল না করা নাজুক এই শিল্পকে আরও বিপন্ন অবস্থায় ঠেলে দেবে। অন্যদিকে টেলিফোনে কথা বলার ওপর বাড়তি কর আরোপ কতটা যৌক্তিক হয়েছে, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
সামাজিক সুরক্ষা খাতে এবার বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে বটে, কিন্তু করোনার কারণে যেসব মানুষ কাজ হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার ওপর থেকে নিচে চলে গেছেন, যাঁরা বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন, তাঁদের সহায়তায় বরাদ্দ নেই। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দুর্নীতি ও অপচয় রোধেও অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।
অর্থমন্ত্রী ২০২০–২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব জাতীয় সংসদে সদ্য পেশ করেছেন। ৩০ জুনের মধ্যে এটি পাস হবে। আরও আলোচনা ও সংশোধনের সুযোগ আছে। আমরা আশা করব, গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে, যা শুধু প্রবৃদ্ধির হিসাব মেলাবে না, গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষের জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা দেবে।
দুঃসময়ের এই বাজেট বাংলাদেশে সুসময়ের বার্তা বয়ে আনুক, এটাই প্রত্যাশিত।
[ad_2]
Source link